অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ইসলামী অর্থব্যবস্থা

অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ইসলামী অর্থব্যবস্থার বিকল্প নেই:

অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা

অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা:

ভূমিকা:

মানব সমাজে অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।মুসলমানগণ যুগ যুগ ধরে কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামী অর্থনীতি অনুসরণ করে আসছে।কিন্তু মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে ধর্মনিরপেক্ষ  পুঁজিবাদী,মুক্তবাজার ও তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক বিধি-বিধান বিশ্ব সমাজকে ব্যাপকভাবে গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে ইসলাম যে অর্থনৈতিক বিধি-বিধান দিয়েছে,মুসলমানগণ তা থেকে দূরে সরে গেছে সাম্প্রতিককালে বিশ্ব ঘটনা প্রবাহে ব্যাপক ও বিচিত্র পরিবর্তন ঘটার কারণে ইসলামী অর্থনীতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিশ্ব সমাজ উপলব্ধি করছে।

সমাজে প্রচলিত অন্য যেকোন অর্থব্যস্থার তুলনায় ইসলামী অর্থব্যবস্থা অনেক বেশী ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণমুখী ব্যবস্থা।পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রাজনৈতিক বা ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে;কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি সেখানে নেই। আবার সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলা হয়েছে;কিন্তু রাজনৈতিক ও আত্মিক স্বাধীনতা নেই। তাইতো বলা হয়ে থাকে, “পুঁজিবাদ মানুষকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়েছে।কিন্তু মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নিয়েছে;অন্যদিকে সমাজতন্ত্রে মানুষ খাবার পেল ঠিকই কিন্তু আত্মাকে হারিয়ে ফেলল।

একমাত্র ইসলামী অর্থব্যবস্থাই এ দুইয়ের মাঝে সমন্বয় সাধনে সক্ষম।ব্যক্তি স্বাধীনতার বিকাশের স্বার্থে ইসলাম যেমন ব্যক্তিসত্তা স্বীকার করে নিয়েছে,তেমনি সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ ও ন্যায়নীতির স্বার্থে ব্যক্তির ওপর কিছু কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তাই বলা চলে,ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল একটি সুষম,ভারসাম্যপূর্ণ ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।কেননা এসব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে ইসলামী অর্থব্যবস্থার কতগুলো মৌলিক ও বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য রয়েছে। যেমনঃ

১) সম্পদের মালিকানাঃ

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যক্তির উপার্জিত সম্পদের একচেটিয়া মালিক ব্যক্তি নিজেই।সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে দেশের যাবতীয় সম্পদের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠিত।পক্ষান্তরে,ইসলামী অর্থনীতিতে সব সম্পদের প্রকৃত মালিক হলেন আল্লাহ।মানুষ এসব সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক মাত্র।তাই ইসলামী অর্থনীতিতে ইচ্ছামতো সম্পদ ব্যয় ও কুক্ষীগত করার সুযোগ নেই।

২) আত্মিক কল্যাণঃ

পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় মানুষের আত্মিক কল্যাণের কোন ব্যবস্থা নেই। ইসলামী অর্থনীতিতে আত্মিক ক্ষতি হয় এমন কোন অর্থনৈতিক কাজ শরীয়তে অনুমোদিত নয়।

৩) বিনিময় ও হস্তান্তরঃ

পাশ্চাত্য অর্থনীতিতে বিনিময় ও হস্তান্তর শুধু বাজারজাত উপাদান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।ফলে কতিপয় ব্যক্তি সমাজের সম্পদের অধিকাংশ মালিকানা ভোগ করে।ফলে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়।ইসলামী অর্থনীতিতে সমন্বিত বিনিময় ও এক তরফা হস্তান্তর নীতি অনুসৃত হয়।এর মাধ্যমে দুর্লভ সম্পদের বন্টন ও বিনিময় পদ্ধতিকে সরাসরি মানুষের সামগ্রিক কল্যাণমুখী করে গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

৪)  অর্থঃ

পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় অর্থই যেন জীবনের লক্ষ্য।এখানে অর্থ উপার্জনের জন্য হালাল-হারাম বিবেচনা করা হয় না।ইসলামী অর্থব্যবস্থায় অর্থ মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য,কিন্তু তা মানব জীবনের লক্ষ্য নয়।হারাম পদ্ধতিতে অর্থ উপার্জন ইসলাম সমর্থন করে না।

৫) নীতিবোধঃ

পাশ্চাত্য অর্থনীতিতে অর্থ উপার্জন ও ভোগের ক্ষেত্রে নীতিবোধের কোন স্থান নেই।এখানে অর্থ উপার্জনই মানুষের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মূল লক্ষ্য।এতে হালাল-হারাম বিবেচ্য বিষয় নয়।কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে নৈতিকতা-বিরোধী ও ইসলাম কর্তৃক অবৈধ ঘোষিত পথে অর্থ উপার্জন করার সুযোগ নেই।এজন্য ইসলামী অর্থনীতিতে সুদ,ঘুষ,কালোবাজারী,মুনাফাখোরী,মজুদদারী ঘৃণিত কাজ বলে বিবেচিত।

৬)সম্পদ ভোগঃ

পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের প্রয়োজনে ভোগের প্রবণতা বাড়ানোর প্রতি উৎসাহিত করা হয়।কিন্তু ইসলামী অর্থনীতিতে মানুষকে সম্পদ ভোগের চেয়ে ত্যাগের প্রতি অধিক উৎসাহ প্রদান করা হয়।মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে,“ধর্মভীরু তারাই,যারা আমার দেয়া রিযিক থেকে মানুষের জন্য খরচ করে।”

৭)বণ্টন পদ্ধতিঃ

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অসম বন্টনের ফলে সম্পদ এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ে।সমাজে এক শ্রেণীর লোক শোষিত ও বঞ্চিত হয়; আর এক শ্রেণীর লোক সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় সম্পদ সরকারকেন্দ্রিক থাকে।ইসলামী অর্থনীতিতে নিজের প্রয়োজন মিটানোর পাশাপাশি অর্জিত উদ্বৃত্ত আয় খোদার রাস্তায় দান এবং যাকাত ও সদকা বণ্টনের মাধ্যমে পুঞ্জিভূত সম্পদের ভিত্তি বিক্ষিপ্তকরণের যে বিধান ইসলামে রয়েছে তার ফলে সুষম বণ্টন যেমন নিশ্চিত হয়,তেমনি সমাজ জীবনে আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠিত হয়।

৮)মানুষ সম্পর্কে ধারণাঃ

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানুষকে প্রধানত সামাজিক জীব হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতেও মানুষ সামাজিক জীব;তবে সে সমাজ ও সমষ্টির গোলাম।পক্ষান্তরে,ইসলামী অর্থনীতিতে মানুষকে শুধু সামাজিক জীব হিসেবেই বিবেচনা করা হয় না; বরং মানুষকে নৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত সামাজিক জীব হিসেবেই দেখা হয়।

৯) উৎসগত পার্থক্যঃ

পুঁজিবাদ,সমাজতন্ত্র প্রভৃতি প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহ মুলতঃ মানব রচিত ব্যবস্থা। লেলিন,কার্ল  মার্কস,এল.রবিনস,কীনস,মার্শাল,এডাম স্মিথ প্রমুখ ব্যক্তিদের চিন্তা-ভাবনার ফলশ্রুতিই হলো এসব অর্থব্যবস্থা।পক্ষান্তরে,ইসলামী অর্থনীতি কোন মানব রচিত অর্থব্যবস্থা নয়।পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ তথা ইসলামী শরীয়তই হলো ইসলামী অর্থনীতির মূল উৎস।

১০) ব্যক্তির অবস্থানঃ

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যক্তি নিজের জন্য কাজ করে আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে।এখানে ব্যক্তির অবস্থান অনেকটা যন্ত্রের মতো।পক্ষান্তরে,ইসলামী অর্থনীতিতে ব্যক্তি নিজের জন্য,রাষ্ট্রের জন্য ও আল্লাহর জন্য কাজ করে।

উল্লেখিত আলোচনার দ্বারা বুঝা যায়,পাশ্চাত্য ভারসাম্যহীন প্রান্তিক বস্তু-সর্বস্ব অর্থনীতি সৃষ্ট সমাজ ব্যবস্থার ইমারত আজ শোষিত,বঞ্চিত মানুষের আর্তনাদ ও বিদ্রোহে প্রকম্পিত হচ্ছে।এ প্রেক্ষাপটে আধুনিক বিশ্বে নয়া অর্থব্যবস্থার সোপান বিনির্মাণ কেবলমাত্র ইসলামী অর্থনীতির মাধ্যমেই সম্ভব।

লেখকঃ শিক্ষক,আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

যোগাযোগ: Faysal’s Education Counsel